রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪৮ পূর্বাহ্ন
শায়খ আবদুল বারী আস সুবাইতি:
আমাদের মাঝে একের পর এক ইবাদত ও কল্যাণের মৌসুম আগমন করতেই থাকে, আর বারবার সুযোগ ও উপলক্ষ আসতে থাকে। বিচক্ষণ ব্যক্তি এ সময় নিজেকে উচ্চমর্যাদায় নিয়ে যায়, ইমানের খোরাক জোগায় ও তার ভান্ডারকে আরও শক্তিশালী করে।
এ মৌসুমগুলো যখন অতিবাহিত হয়ে যায়, তখন অনেকের অবস্থার পরিবর্তন ঘটে; আমলের তৎপরতা দুর্বল হয়ে আসে ও উদ্যমতা কমে যায়। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক কর্মের উদ্যমতা আছে এবং প্রত্যেক উদ্যমতার সঙ্গে আছে নিরুদ্যমতা। সুতরাং যার নিরুদ্যমতা আমার সুন্নাহর গণ্ডির ভেতরে থাকে, সে হেদায়েতপ্রাপ্ত হয় এবং যার নিরুদ্যমতা এ ছাড়া অন্য কিছুতে (সুন্নত বর্জনে) অতিক্রম করে, সে ধ্বংস হয়ে যায়।’ মুসনাদে আহমাদ
এটা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে, যেন বছরব্যাপী আমলের জন্য নিরাপদ পন্থা ও সুদৃঢ় নির্দেশিকা সম্পর্কে পরস্পরকে জিজ্ঞেস করি। এ ক্ষেত্রে আমরা স্বস্তিদায়ক জবাব ও পরিপূর্ণ জ্ঞান পেতে পারি নবী করিম (সা.)-এর আদর্শ থেকে. যা উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) প্রকাশ করেছেন। যখন আলকামা (রহ.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, নবী করিম (সা.)-এর আমল কেমন ছিল? তিনি কি কোনো দিনকে কোনো আমলের জন্য নির্দিষ্ট করে নিতেন? উত্তরে হজরত আয়েশা (রা.) বললেন, ‘না, বরং তার আমল স্থায়ী হতো।’ সহিহ বোখারি
অর্থাৎ তিনি সর্বদা আমল করতেন, ছেড়ে দিতেন না। তা ছাড়া হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় আমল তাই যা সদাসর্বদা নিয়মিত করা হয় যদিও তা অল্প হয়।’ সহিহ বোখারি
নববি এ আদর্শ এবং ইবাদতের এ নীতি স্রষ্টার সঙ্গে ব্যক্তির স্থায়ী সম্পর্ক তৈরি করে এবং তাকে স্বীয় রবের অভিমুখী করে। অল্প আমল হওয়া সত্ত্বেও তা নিয়মিত পালন করা একটি সরল পথ ও মধ্যপন্থা। এটা অন্তরের জন্য মানানসই; তাতে আপনি কষ্ট অনুভব করবেন না। বরং এ অল্প আমল ভিন্নভিন্ন হওয়ার কারণে তার প্রতি হৃদয় আরও উদগ্রীব ও অগ্রসর হয়। নিয়মিতভাবে স্বল্প আমল অনেক; তা বিশুদ্ধ নিয়তের সঙ্গে বহুগুণ বর্ধিত হয় এবং হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। জেনে রাখুন, আপনার দৃষ্টিতে যে সময়টিকে আপনি নগণ্য মনে করছেন, সেটাকে যদি স্থায়ী আমল দ্বারা সদ্ব্যবহার করেন; তাহলে যেন আপনি জীবনের এ সময়টিতে অনেক কিছুই সম্পাদন করলেন।
হাদিসটি এদিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে যে, শুধু আমলের চেয়ে আমলের ওপর অবিচল হওয়া অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত আসল বিষয় হলো, আমল শুরু করুন ও তা চালিয়ে যান। যে ব্যক্তি নিয়মিত আমল করে যায় সে সম্মান ও মর্যাদার শিখরে উন্নীত হয়। ‘যা সদাসর্বদা নিয়মিত পালন করা হয় যদিও তা অল্প হয়।’ নববি এ উচ্চ মূলনীতিটি মেনে চলেছেন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিরা। তারা শ্রেষ্ঠ গুণাবলির ঝরনা থেকে সুধা পান করেছেন; ফলে এর দ্বারা তারা এমন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, যারা অনুসরণীয় এবং তারা এমন আদর্শ হয়েছেন যাদের পদাঙ্ক অনুকরণীয়। তাদের প্রত্যেকেই নফল আদায়ের সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে তার প্রতি দ্রুত অগ্রসর হয়েছেন। সে আমলই পছন্দ করতেন যা পালন করতে সক্ষম হতেন, সে ইবাদত বাছাই করতেন যার প্রতি হৃদয়ের টান অনুভব করতেন; নামাজ, দান-সদকা, সদাচরণ, সম্পর্ক রক্ষা ইত্যাদি। তারা এগুলো পালনের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতেন, এসব আমলের ওপর অবিচল থাকতেন। ফলে তারা আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় মানুষে পরিণত হন।
সহিহ মুসলিমে এসেছে, উম্মুল মুমিনিন উম্মে হাবিবা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, ‘যে ব্যক্তি দিবা-রাতে বারো রাকাত (সুন্নত) নামাজ আদায় করবে, তার প্রতিদানে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করা হবে। উম্মে হাবিবা (রা.) বলেন, যখন আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে এ কথা শুনেছি তখন থেকে এই নামাজগুলো কখনো ছাড়িনি।’
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবার-পরিজন কোনো আমল শুরু করলে তা স্থায়ীভাবে সর্বদাই করতেন।’ সহিহ মুসলিম
সহিহ বোখারির বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এক দিন ফজরের নামাজের সময় হজরত বিলাল (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে বিলাল! ইসলাম গ্রহণের পর সর্বাধিক আশাব্যঞ্জক যে আমল তুমি করেছো, তার কথা আমার কাছে ব্যক্ত করো। কেননা জান্নাতে আমি আমার সামনে তোমার জুতার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। হজরত বিলাল (রা.) বললেন, দিন-রাতের যেকোনো প্রহরে আমি যখনই পবিত্রতা অর্জন করেছি, তখনই সে অজু দ্বারা নামাজ আদায় করেছি, যে পরিমাণ নামাজ আদায় করা আমার তাকদিরে লেখা ছিল। আমার কাছে এর চেয়ে অধিক আশাব্যঞ্জক হয়, এমন কোনো বিশেষ আমল আমি করিনি।’
আর হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা এক দিন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে নামাজ আদায় করছিলাম। লোকদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল, আল্লাহু আকবার কাবিরা, ওয়ালহামদুলিল্লাহি কাসিরা, সুবহানাল্লাহি বুকরাকান ওয়াআসিলা অতঃপর রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই বাক্যগুলো বলেছে? লোকদের মধ্য থেকে একজন বলল, আমি বলেছি ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি বললেন, আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম, ওইগুলোর জন্য আকাশের সব দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। ইবনে উমর (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এই কথা শোনার পর থেকে আমি কোনো দিন এই বাক্যগুলো পড়া বাদ দিইনি।’ সহিহ মুসলিম
যদি কোনো ব্যক্তি কোরআন মজিদ মুখস্থ করা, জ্ঞানার্জন করা, নবী করিম (সা.)-এর জীবনী পাঠ, কোনো উপকারী বই পড়া, সন্তানদের শিক্ষাদান, নফল আমল আদায়, আল্লাহর জন্য কোনো সৎকর্ম সম্পাদন, পার্থিব উপকারী কোনো কাজে নিয়মিত অল্প সময় নির্ধারণ করে সে অচিরেই স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছাবে ও তার আশা পূর্ণ হবে। অচিরেই সে এর সুফল পাবে জীবনের উন্নতিতে, চিন্তার বিকাশে ও অন্তর্দৃষ্টির অগ্রগতিতে। এটা তাকে একটি গঠনমূলক উপাদানে পরিণত করবে, যা তার সমাজকে বিকশিত করে ও দেশকে উন্নত করে।
এতটুকু জেনে রাখুন, যে ব্যক্তি কোনো সৎ আমলে অভ্যস্ত হয়, তারপর সে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে বা সফরে যায়; তাহলে এমতাবস্থায় সে যেন ওই আমলটিই করল। যেমনটি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এ বাণীতে এসেছে, ‘যখন বান্দা রোগাক্রান্ত হয় কিংবা সফর করে, তখন তার জন্য তাই লিখিত হয়, যা সে মুকিম অবস্থায় বা সুস্থ অবস্থায় আমল করত।’ সহিহ বোখারি
প্রত্যেকের আমলে ও অবস্থায় ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। কেননা ইবাদতে কৃত্রিমতা অবলম্বন ও নিজের নফসের ওপর কঠোরতা করা, অপারগতা ও ছেড়ে দেওয়ার দিকে ধাবিত করে এবং এটা অনীহা, বিরক্তি ও ক্লান্তি তৈরি করে। কখনো এটা আমল বিনাশকারী অধঃপতন ও ধ্বংসাত্মক সীমালঙ্ঘনের দিকে নিয়ে যায়। তাই এ ব্যাপারে নবী করিম (সা.)-এর নির্দেশনা এসেছে, যাতে এমন অবস্থার ব্যক্তি নিজেকে সুন্দরভাবে নববি নির্দেশনার দিকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
৩০ জুন শুক্রবার, মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান